Monday, August 6, 2007

দেখা সিনেমা : স্বপ্নডানায়

১.
'স্বপ্নডানায়' সিনেমা দেখলাম গতকাল। উদ্বোধনী প্রদর্শনী ছিল, স্টার সিনেপ্লেক্সে।

প্রযোজনায় ইমপ্রেস টেলিফিল্ম, এফডিসির বিকল্প আইকন এখন; ড্রইংরুমের টিভি দর্শককে বড়পর্দার ভোক্তা করতে প্রতিষ্ঠানটি বিড়ালপ্রসবের মতো সিনেমা উৎপাদনে মত্ত। নিবেদনে বাংলালিংক কোম্পানি, যার সম্ভাব্য গ্রাহক হয়তো 'সুস্থধারার ছবি'-এর দর্শকদের ভেতর থেকেই মিলবে বলে বিশ্বাস।

পরিচালক গোলাম রাব্বানী বিপ্লব, পরিচালনায় নতুন মুখ, তবে 'দেশী সিনেমার রাজনীতি'তে চেনামুখ, বাংলাদেশ সিনেমা উৎসবের আয়োজক হিসেবেও পরিচিত। গেল জুনে দশম সাংহাই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের এশিয়া নিউ ট্যালেন্ট ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পেয়েছেন তিনি, শ্রেষ্ঠ পরিচালকের।

বিদেশী চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার যোগ, দেশী মিডিয়ার কাঠগড়ায় 'সুস্থ ধারার' সনদ, সমালোচকদের কয়েক কলাম বন্দনা আর স্টার সিনেপ্লেক্সের মতো অভিজাত প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি-- সব মিলে একটা ইমেজ ও আমেজ তৈরি করার চেষ্টা প্রচারণায়, পরিবেশনায়। ভালো সিনেমার ইমেজ। ভালো।

বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি যখন সংকটে, টিভি-পত্রিকাগুলো তখন 'ছিঃনেমা অসুস্থ অশ্লীল অরুচিকর' বলে গালি দেয়। তারপর নিজেরা দায়িত্ব নেয় দর্শকদের রুচি তৈরি করার, সিনেমার ভালোত্বের বিচার করার। 'আর্ট ফিল্ম, বিকল্প ধারা, অবাণিজ্যিক ধারা' শব্দগুলো সেকেলে, দর্শক খায় না আর, বিকল্পধারাআন্দোলন করে ফেনা তুলেছে ফিল্ম সোসাইটির লোকে, তারও নমুনা দেখেছে দর্শক, এবং দেখে ক্লান্ত। তাই মোড়ক বদল। নতুন ট্যাগ। 'সুস্থ ধারা, রুচিসম্মত সিনেমা'।

সিনেমার স্বাস্থ্য নিয়ে উৎকণ্ঠিত মিডিয়ার কাছে প্রশ্ন, কী কী উপাদান (না) থাকলে সিনেমাকে সুস্থ এবং ভালো বলেন আপনারা?

'স্বপ্নডানায়' সিনেমা কেন ভালো?

সিনেমাটা কী নিয়ে?

গ্রামের এক ক্যানভাসার ঘটনাক্রমে কিছু বিদেশী নোট পায়। এই নোটের দেশী মূল্যমান কত হবে, চিন্তায় পড়ে সে, স্বপ্ন দেখে তার পরিবার। টাকার মালিক হবার স্বপ্নে তার জীবনযাত্রা বদলে যায়, কাছের মানুষদের সাথে সম্পর্কের অবনতি হয়। পরে জানতে পারে, নোটগুলো অচল। স্বপ্ন ভেঙে যায়। উপলব্ধি করে, এই সামান্য কয়টা কাগজের নোট যত নষ্টের মূল। তারপর আবার আগের জীবনে ফিরে যায়। পরিচালক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষরাও কীভাবে অল্পতে সন্তুষ্ট হতে পারে, সে দৃশ্য ছবির উপজীব্য হয়েছে।

টাকার পেছনে না ছুটে অল্পতে সন্তুষ্ট হও, সেটাই ভালো, সেখানেই সুখ-- গ্রামের নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য এই দর্শন কেন বেছে নিলেন লেখক-পরিচালক, প্রযোজক আর নিবেদক?

ব্যস, আর বিশ্লেষণ কোরো না।
এত বুঝে কাজ নেই।
পুপু পুপু পু।

২.
তাহলে সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখার বয়ান দিই।

সিনেমার মূল চরিত্র একজন ক্যানভাসার, অভিনয়ে মাহমুদুজ্জামান বাবু, মলম বেচে, নওগাঁ জেলার গ্রামের হাটে হাটে। দশ বছরের ছেলে রতন গান গেয়ে সাহায্য করে বাবাকে। একদিন, বাড়ি ফেরার সময়, ছেলের জন্য একটা পুরনো প্যান্ট কেনে বাবু। সেই প্যান্ট ধোয়ার সময় পকেটে কিছু বিদেশী নোট পায় ক্যানভাসারের বউ, রোকেয়া প্রাচী। ততক্ষণে সিনেমার বারো মিনিট পার। পর্দায় দেখি, রাতের দৃশ্য, ইনডোর শট, বাবু তোষকের নিচে লুকিয়ে রাখে নোটগুলো।

কোন দেশের নোট এগুলো, দেশী টাকায় এর মূল্য কত, এত টাকা পেলে কী করবে, একে ঘিরে শুরু হয় স্বপ্ন। স্বপ্ন মানে, টেকনিক্যালি বললে, মোশন স্লো করে দৃশ্য ঢোকানো, সিনেমাভাষার ক্লিশে কায়দা। যেমন রোকেয়া প্রাচীর স্বপ্ন, তাদের প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে। খুঁড়িয়ে নয়, দৌড়ে আসছে তার কাছে, ধীরগতিতে। প্রাচী আরও দেখেন, স্বপ্নদৃশ্য, বিয়ের সাজে বসা তার আরেক মেয়ে, গোবর লেপছিল মূলত মেয়েটি। এই সিকোয়েন্সের শুটিং মনে পড়ে, অ্যারিফ্লেক্স ক্যামেরা তাক করে আছেন সিনেমাটোগ্রাফার মাহফুজ-উর রহমান, ছবি তুলছিলাম একটু দূরে দাঁড়িয়ে, সিনেমার ওয়ার্কিং স্টিল, বেশ গরম ছিল গত বছর জুনে, প্যাচ শুটিংয়ে।

ক্যানভাসার তার ছেলেবেলার বন্ধু মেম্বারকে, অভিনয়ে ফজলুর রহমান, জানায় নোটের কথা। বন্ধু রাজি হয়, তবে টাকা পেলে ভাগ দিতে হবে, এই শর্তে। গ্রামের ব্যাংকে বিদেশী নোট লেনদেন হয় না। তাই ক্যানভাসারকে নিয়ে মেম্বার যায় দুলাভাইয়ের কাছে, ঢাকায় যাতায়াত আছে যার। নোটের একটা ফটোকপি নিয়ে দুলাভাই যায় ঢাকা, গিয়ে খবর পাঠায়, দেশি টাকায় এর দাম নাকি অনেক। ততক্ষণে স্যান্ডউইচ, কফি পৌছে গেছে দর্শকদের মাঝে। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক বদান্যতা! কফি খাও আর স্বপ্নডানায় দেখো। সিনেপ্লেক্সে প্রিমিয়ার শো বলে কথা।

অন্যদিকে, সাবপ্লট শুনুন, মেম্বার বন্ধুর বাড়িতে এক বউ, এক শালী। মেম্বার তার বউকে নোটের কথা জানায়। শালী শোনে তা আড়ালে। তারপর ক্যানভাসার বাবু এলেই কপিলাসুলভ হাসি দেয়। বাবু সিনেমা দেখতে নিয়ে যায় বন্ধুর শালীকে। স্বপ্ন দ্যাখে সে, বিয়ে করে নিয়ে যাচ্ছে বন্ধুর শালীকে। পাশের সিটে বসা দর্শক মজা পায়, খিখিখিখি শব্দ করে, সেটা হাসি, আমার অনুমান।

গ্রামে গুজব ছড়ায়। বউ আঁচ করে। চার্জ করে ক্যানভাসার বাবুকে। বাবু রেগে যায়, বউয়ের চুল ধরে, মাটিতে ফেলে দেয়, পা দিয়ে ঠেসে ধরে গলায়। ইচ্ছে করে একটু ডিটেইলে বললাম লাইনটা।

ফ্রেমের বাইরে থেকে প্রতিবেশী দৌড়ে আসে, সে যাত্রায় বেঁচে যায় বউ। তবে বউ, সিনেমার স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী, পরদিন গোপনে নোটগুলো চুলার আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে নেয়, কিন্তু সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। কাট। নোটগুলো আগুনে পোড়ায় কিনা, জানা হয় না। সিনেমার হুক।

অধৈর্য হবেন না। প্রায় শেষদিকে। বন্ধু আর ক্যানভাসার বাবু যায় নওগাঁ শহরে, ব্যাংকে নোটের ফটোকপি দেখায়। ব্যাংক থেকে জানতে পারে, এই নোট এখন অচল।

বন্ধুর মেজাজ খারাপ হয়, মোটরসাইকেল নিয়ে চলে যায়, ক্যানভাসারকে মাঝপথে রেখে।

ক্যানভাসার বাবু বাড়ি ফিরে বউকে শুধায় নোটের কথা। বউ খাম থেকে নোট বের করে, হুক খোলস ছাড়ায়, দর্শক দেখে, টুকরো টুকরো করে ছেড়া। ছেড়ার কারণ, বউ বলে, এত টাকার দরকার নাই। ক্যানভাসারও কাঁদতে কাঁদতে সায় দেয়, ঠিক, এত টাকার দরকার নাই। তারপর জড়িয়ে ধরে তারা কাঁদে, সিনেপ্লেক্সের বোদ্ধা দর্শকদের সামনে। তারপর ছেলেমেয়েরা ফ্রেমে ঢোকে। গান শুরু হয় আবহে। মানসী সাধুর গলায়, সেটা প্রমিত উচ্চারণে, 'জানি একদিন ভোর হবে...' ওহ নো, আবার আশাবাদী গান।

লং শট। ক্যামেরাকে পেছনে ফেলে ক্যানভাসার তার ছেলেকে নিয়ে কাজে বেরিয়ে যায়।
অভিজ্ঞ দর্শক বুঝে ফেলে, সিনেমা শেষের পথে, উঠতে থাকে দুয়েকজন।
আবহে গান চলছে। দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে তারা।
এবং শেষ। টাইটেল ওঠে কালো ফ্রেমে।

৩.
সংলাপে নওগাঁর আঞ্চলিক টান আনতে পারেনি চরিত্রগুলো। বাড়তি সিকোয়েন্স আছে অনেক জায়গায়, সিনেমার মেদ, গল্প এগিয়ে নেয় না, সম্পাদনায় বাদ দেয়া যেতো। ক্যামেরার কাজ ভালো লাগেনি। যেমন, শটের মাঝে প্যান বা জুম করা, এ স্টাইল অপছন্দ আমার, দ্বিমাত্রিক-ফ্ল্যাট লাগে, তার চেয়ে ভালো স্ট্যাটিক শট। আবার ঘন ঘন ক্রেন ও ট্রলির ব্যবহার অহেতুক ঠেকে, ছিল-তাই-ব্যবহার-করা গোছের। তার দায় সিনেমাটোগ্রাফারের উপর বর্তায় না, পরিচালক এমনভাবে শট বিভাজন করেছেন বলেই তো। ধীরে নেয়া ক্রেন শটে ফ্রেম নড়ে-দোলে, জার্ক করা যাকে বলে। কিছু শটে শার্পনেস কম এবং আউট অব ফোকাস। রঙের টোন মেলেনি কয়েক জায়গায়। একটা দৃশ্যে হলুদ আভা, ম্যাচ কাটে শট বদল, আর হয়ে গেল নীলচে! কারিগরি দুর্বলতা ছাড়া এর আর কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাইনি। মেম্বার বন্ধু তাকে ছেড়ে চলে গেলে, ঘাসের দিকে তাকায় ক্যানভাসার বাবু। ঘাস ফুড়ে আবছা ভেসে ওঠে বউমারার দৃশ্য। কল্পনাদৃশ্য বোঝাতে সুপারইমপোজ কায়দার বিকল্প ছিল না?

৪.
উদ্বোধনী প্রদর্শনী হলে অনেকের সাথে দেখা হয়। এবারও হলো। সম্পাদক জুনায়েদ হালিম লম্বা চুল রেখেছেন। শাহীন দিল-রিয়াজকে পেলাম। জার্মানি থেকে ঢাকা এসেছেন দিন দশেক আগে। থাকবেন সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তার নতুন ডকুমেন্টারি লোহাখোর নিয়ে আলাপ হলো। বললেন, এশিয়ার কিছু উৎসবে জমা পড়েছে। সেখানে শেষ হলে ঢাকায় দেখাবেন। আগামী বছরের আগে না। পরের সিনেমাটা ফিকশনধর্মী করার ইচ্ছা।

আসছে শুক্রবার কয়েকটা হলে মুক্তি পাবে সিনেমাটি। ইংরেজি শিরোনাম রাখা হয়েছে: On the Wings of Dreams.

সপ্তাহজুড়ে পত্রিকার বিনোদন পাতাগুলো এ সিনেমা নিয়ে নিশ্চয়ই আরও রসিয়ে লিখবে। আর সুস্থধারা, সুস্থধারা করে মাতম তুলবে।

যত্তোসব!

-- ইশতিয়াক জিকো / ঢাকা / ৬ আগস্ট ২০০৭

1 comment:

Anonymous said...

Hi,

Im looking for the poster (affiche) of the movie On the Wings of Dreams, please send the pic to my email

riconster@gmail.com

Thanks!

Post a Comment