দেখা নাটক : একশ' বস্তা চাল
গেল মাসের শেষ রাত কেটেছে শিল্পকলার নাট্যশালায়, জাপানি নাটক একশ' বস্তা চাল দেখে। বাড়ি ফিরেছি ঝুমবৃষ্টিতে। ফিরেই রুটিনমাফিক লোডশেডিং উপভোগ আর যাবতীয় প্রথাযাপন।
একশ' বস্তা চাল একটি চমৎকার বাজে নাটক। পাণ্ডুলিপি ইউজো ইয়ামামতো'র। নির্দেশনায় গোলাম সারোয়ার, নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগের উপপরিচালক তিনি। প্রযোজনায় শিল্পকলা একাডেমী নিজেই। আর প্ররোচনায় দুর্নীতি দমন কমিশন। জাপান দূতাবাস প্রযোজনা সহযোগী ছিল।
এ নাটক মঞ্চায়নের আরেক উদ্দেশ্য, সরকারি মেসেজ দেয়া। বাজে মনে হবার অন্যতম কারণ এটি। অবশ্য সরকার নাটকের মাধ্যমে জনগণকে মেসেজ দিতেই পারে, যেহেতু ধরে ধরে সবাইকে আফিম খাওয়ানো কষ্টসাধ্য।
শেষ অঙ্কে উপদেষ্টা বোঝান পাবলিকসম সামুরাইদের: চাল বিলি করলে তা দু দিনেই ফুরিয়ে যাবে, আর চাল বেচার টাকা স্কুলের পেছনে খরচ করলে শিক্ষিত হবে জনগণ, তখন একশ' কেন, হাজার বস্তা চাল উৎপাদন করা যাবে।
সামনের সারির দর্শকরা অন্ধকারে বসে হাততালি দেন।
এদিকে, মঞ্চে উপস্থিত সামুরাই যোদ্ধারা গাঁইগুঁই করে, যুক্তিতর্কে পারে না, শেষে জাপানি স্টাইলে গুরুবাদিতার জয় হয়, শ্রদ্ধায় তারা হাঁটু গেড়ে বসে, মাথা নত করে উপদেষ্টার সিদ্ধান্ত ও দূরদর্শিতার কাছে।
নাটকের আলোক নির্দেশনায় ছিলেন ঠাণ্ডু রায়হান। মঞ্চের কোণে তিনি উজ্জ্বল আলো ফেলেন। আর উপদেষ্টা সেখানটায় গিয়ে আশার বাণী কপচান, ওরে দ্যাখ, ওই তো আলো, নতুন সূর্য, সুন্দর আগামী অপেক্ষা করছে। আবহ সঙ্গীতের লয় বাড়তে থাকে।
নাটক শেষ হয়।
ভাবনা শুরু হয়।
ভাবনার প্রথম স্তর নাটকের পরিণতি নিয়ে, যেখানে হাইলাইট হয় প্রধান উপদেষ্টার সিদ্ধান্ত, সাময়িক সমাধানে না গিয়ে স্থায়ী সমাধানের পথের ব্যবস্থা করা। অথবা ভিন্নপাঠে: ভবিষ্যতে সুখের জন্য বর্তমানের কষ্টকে সহ্য করে যাওয়াই সঠিক সিদ্ধান্ত।
কিন্তু একশ' বস্তা চাল বেচে স্কুলের ভৌত অবকাঠামো তৈরি আর সেখান থেকে শিক্ষিত-স্বাবলম্বী হয়ে দারিদ্র্যমোচন করার যে স্বপ্ন-- এ দু'য়ের মাঝে অসংখ্য ধাপ ও নিয়ামক আড়ালে থেকে যায়, উপদেষ্টার 'রোডম্যাপ' পরিস্কার হয় না। স্বপ্নটা বরং সরকারি-সরকারি মনে হয়।
মঞ্চে সামুরাইরা মেনে নেয়। কিন্তু ২০০৭ এর বাংলাদেশে বসে আমার খটকা দূর হয় না, কেমন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হয়।
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত?
হ্যাঁ, সেটা দ্বিতীয় স্তরের ভাবনা। নাটকের মঞ্চায়নের উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবি। কেন ১৪০ বছর আগের কাহিনীঅলা এই জাপানি নাটক বেছে নিলো সরকারি প্রতিষ্ঠান? শুধু কি জাপান-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সম্পর্ক উন্নয়ন?
উনিশ শতকে জাপানে মেইজি শাসনামল নিয়ে যারা জানেন, তারা তো জানেনই, তাও মনে করিয়ে দিই, মেইজিদের কারণে জাপানে বেশ বড় পরিবর্তন আসে, শিল্পায়নে এগিয়ে যায় তারা, এবং তার জের ধরে ১৯০৫ সালে ক্ষমতায় আসে মিলিটারি।
নাগাওকার এ ঘটনাকে আদর্শ হিসেবে প্রচার করতেন জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কোইজুমি।
বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারও কি সেই নীতি সমর্থন করতে বলে?
এর একটা উত্তর পাই নাটক মঞ্চস্থ হবার আগে দেয়া বক্তব্য থেকে। দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব মো: মোখলেস উর রহমান এসেছেন প্রধান অতিথি হয়ে, আগেরবার মঞ্চায়নেও তিনি বক্তৃতা দিয়েছেন। তাঁর দেখা ভালোলাগা নাটক এটি। দর্শকদের বললেন, নাটকটি অনেক আগের হলেও এ সময়ের জন্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এই যে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ছে, এবং বাড়ছেই, তা যেন আমরা সহ্য করি দাঁতে দাঁত চেপে। নয়তো দুর্নীতি দমবে না, সুনীতি প্রতিষ্ঠা হবে না।
তারপর শুরু হলো আমলাবাজি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গান গাইলেন। বিশ্বাসযোগ্যতা আনতে স্বর ওঠানামা করে কোরআনের আয়াত দিলেন। দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের উদাহরণ দিতে মকবুল ফিদা হুসেনের সাম্প্রতিক প্রেম টানলেন, ভারতের এপিজে আবদুল কালাম পাড়লেন। উঁচু রসবোধের প্রমাণ দিতে গিয়ে অভিনেত্রী শাবনূর নিয়েও কি এক ফোড়ন কাটলেন। সেই সাথে মাইক্রোফোনকে সাক্ষী রেখে হাসির মতো শব্দ করলেন অনেকবার।
নাটকটা দেখবো বলে প্রায় ঘণ্টাখানেক দাঁতে দাঁত চেপে এসব সহ্য করেছি!
আর দেখুন, নাটক দেখে সহ্যক্ষমতা আরও বাড়ছে আমার। এভাবে বাড়তে থাকলে কাঁচামরিচের ২০০ টাকা কেজি দর অথবা তিন দিন বিদ্যুৎহীনতায় ডেসার নিস্পৃহ মনোভাব-- কোনো ব্যাপার না, পানিভাত!
এবং তারপর দুম করে আমরা একদিন সামুরাই হয়ে যাবো, আর বাংলাদেশি স্টাইলে মাথা নত করবো প্রধান উপদেষ্টার কাছে।
তবু শেষ হবে তো এ নাটক?
ইশতিয়াক জিকো / ৪ আগস্ট ২০০৭, ঢাকা
_____________
ছবিসূত্র : নিউ এজ পত্রিকা
2 comments:
ha ha ha......hah ....ha .haa....hihihihihi..emon ekta likha golapjan neio likho...6 aug..r frndship dibisher suvecca..jahajti tar ofuronto jalani nie cholte thakok..bondorer durotto jotoi hok
সারওয়ার স্যারকে তো আমার বেশ অনেক ভালো লাগতো, আমি খালি উনার একটাই প্রোডাকশন দেখেছি-- মুক্তিযুদ্ধের কথা অমৃতসমান, ভালো লেগেছিলো। উনি এরকম একটা গাঁজাখুরি ধরনের নাটক বানিয়েছেন জেনে একটু খারাপ লাগছে। আপনার এই লেখাটা ভালো লেগেছে, লেখকের অনুভুতির তীব্রতা স্পর্শ করা যায় এই লেখাতে। অতএব,"জাহাজটি তার অফুরন্ত জ্বালানি নিয়ে চলতে থাকুক.. বন্দরের দূরত্ব যতই হোক।" :)
ও আর আরেকটা কথা, আমাদের সামুরাই হওয়ার প্রক্রিয়া কিন্তু ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে, তাই নয় কি?
Post a Comment