Saturday, April 1, 2006

ভাবনার স্প্রে ০০১

১. এসব দেখি কানার হাট-বাজার...

এ লেখার আগের দুটো পোস্ট চিন্তা নিয়ে চিন্তা এবং কারণ আমরা মাদ্রাসায় পড়ি-এর মন্তব্যগুলো পড়লাম। একটা বিষয় অদ্ভুত! যারা পোস্টটিতে ভিন্নমত দিয়েছেন, তাদের সাথে আমার মত প্রায় মিলে যায়। আর লেখায় উৎসাহ দিয়ে সহমত পোষণ করেছেন যাঁরা, তাঁদের সাথে মতাদর্শের ভিন্নতা রয়ে যাচ্ছে।

এমনটা মনে হচ্ছে কেন? হতে পারে, বক্তব্য উপস্থাপনায় গলদ আছে। যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখাটি তুলে দিয়েছিলাম, আর লেখাটা যেভাবে নেয়া হয়েছে, দুটোয় মেলেনি। সান্ত্বনা দিলেন আপনি, লেখক-পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গির এ তফাৎটুকু থাকেই।

কিন্তু তাই বলে এত ভিন্নতা?

তাহলে এ কারণ অন্যভাবে বলা যায়, লেখাটি স্বচ্ছ করে লিখতে পারিনি। 'লিখতে পারিনি' কথাটায় বিনয়ের গন্ধ পেলেন। অভিযোগ করলেন, বিনয় হলো উন্নাসিকতা ঢাকার একটা কৌশল! বাক্যের পুনর্বিন্যাস করা হলো : 'স্বচ্ছ করে লিখিনি'। এবার আক্রমণ : 'আপনি আসলে স্বচ্ছ করে লিখতে পারেন না'।

'স্বচ্ছতা' শব্দের অর্থ নিয়েও ব্যক্তিবিশেষে 'অস্বচ্ছতা'।

এ রকম সমস্যা অনেকের বেলায় হয় নিশ্চয়ই। একই ভাষায় যোগাযোগ করি, তারপরও যোগাযোগটা হয় না 'ঠিকমতো'। এসব নিয়ে একটু ভাবনার স্প্রে ছিটাই। বিভ্রান্তির মশামাছিতেলাপোকারা বিরক্ত করছে বেশ...

একটা গিমিনাট্য দিয়ে শুরু করা যাক। খসড়া লিখেছি কেবল। শিরোনাম : 'এসো ট্যাগ লাগাই'। 'প্রাপ্তবয়স্কদের' জন্য রচিত এ গিমিনাট্য পড়ার আগে এর আগের দুটো পোস্ট (মন্তব্যসহ) পড়ে নিন।

<গিমিনাট্য শুরু>

- সিকোয়েন্স এক -
সামহোয়্যারইন রোড। সন্ধ্যাবেলা। রাস্তায় রিকশা, ট্যাক্সি, মোটর সাইকেল আসছে-যাচ্ছে। বাঁ পাশের ফুটপাতে সানগ্লাস চোখে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে। হাতে একগাদা ট্যাগ (স্টিকার বা লেবেল)। বেশিরভাগ চোখ রিকশার ওপর। মাঝে মধ্যে রিকশা আটকাচ্ছেন। পছন্দ না হলে একপাশে নিয়ে যাচ্ছেন। ট্যাগ লাগিয়ে দিচ্ছেন।

ট্যাগ লাগানো এক ধরনের খেলা। পুরনো খেলা। আদর করে 'ট্যাগট্যাগ'-ও বলেন অনেকে। একেক ট্যাগে একেক বিশেষণ লেখা থাকে। দ্রুত লাগাতে হয় এসব ট্যাগ, অনেকে মিলে। দ্রুত খেলতে হয় বলে সমস্যাও হয়। তবে এ সমস্যা অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সুবিধা, খেলার জনক কথাটা প্রায়ই বলেন। রাস্তায় কেন এ খেলা? উত্তরে নূরানি হাসি। বলেন, মাঠের খেলা ক্রিকেট। রাস্তার খেলা ট্যাগট্যাগ।

আবার ফিরে যাই সে রাস্তায়, সন্ধ্যাবেলায়, ফুটপাতের ধারে, বাঁ পাশে। ট্যাগট্যাগ চলছে। কেউ ট্যাগ লাগাচ্ছেন রিকশার গায়ে। কেউ লাগাচ্ছেন রিকশাআরোহীর শরীরে, জামায়। রিকশাচালক কিছু বলতে চান। তিনিও 'ট্যাগ খান'।

দুয়েকজন খেলা সমন্বয় করতে এগিয়ে আসেন। এইখানে না, ওইখানে, ওইখানে ট্যাগ লাগাও। এভাবে লাগায় নাকি? কোন ইশকুল থেকে ট্রেনিং নেয়া তোমার? ওই, আঠা শেষ। দোকান থেকে আঠা নিয়ে আসো। কুইক।

শব্দমুখর খেলা। এক বাক্যের শব্দ আরেক বাক্যের ঘাড়ে ওঠে। কে কাকে নির্দেশনা দিচ্ছেন, কেউ তা দেখছেন না। খেলাটাই আসল। হি হি হি।

ট্যাগ ট্যাগা ট্যাগ ট্যাগ
ট্যাগা ট্যাগ ট্যাগা ট্যাগ
(আবহ সঙ্গীত হিসেবে এ নিরীহ মিউজিক বেছে নিলাম। আমরা একটু পর দুই নম্বর সিকোয়েন্সে যাবো। তখন সঙ্গীত আপনাআপনি মিলিয়ে যাবে।)

- সিকোয়েন্স দুই -
রাস্তার এপাশে, ওপাশে ছোটখাটো ভিড় জমে গেছে। ট্যাগট্যাগ খেলা দেখার লোক। কী-হয়-কী-হয় কৌতূহল। চাপা উত্তেজনা। নিজেদের মধ্যে ফিসফাস গল্প চলে। এ রাস্তায় নাকি এমন খেলা কারও চোখে পড়েনি।

আরেকজন 3 : সুন্দর খেলা, ভালোই তো লাগছে, মাইরি।
আরেকজন 14 : যাহ, বিদেশ ছিলেম যখন, এমন খেলা কত দেখে এলেম।
আরেকজন 15 : বিদেশ তো আমিও আছিলাম। যাই বলেন, খেলাটা এই রাস্তায় একটা নতুন মাত্রা আনতাছে। আই অ্যাম ফিলিং ইট।
আরেকজন 9: নষ্ট ল্যাম্প পোস্টটার উপরি হেবি রাগ হতিছে। বাতি ঠিক থাইকলে খেলাটা দেইখে বড় সুখ লাইগতো।
আরেকজন 2: বাঙঙঙ গালি! খাইবার দিলে সবটি বইবার চায়। ওমমিয়া, সাইড লন, খেলা দেখবার দ্যান।
আরেকজন 6 : ম্যালা খেলা দেখনু। বাহে, আইসো, মুড়ি খাই।

কেউ আবার উৎসাহ দিতে মাঝরাস্তায় চলে আসেন। দুয়েক বার শিস দিয়েই আবার ভোঁ দৌড় ওপাশে। উফ, ট্রাফিক পুলিশটা আচ্ছা ত্যাঁদোড়। খেলার গ-ও যদি বুঝতো!

খেলা চলছে। ভিড় বাড়ছে। জমে উঠছে। কে জিতবে কে হারবে, দূর থেকে বোঝা যায় না।

জটলা দেখে ট্রাফিক পুলিশ হঠাৎ সম্বিত ফিরে পান। দায়িত্ব, হ্যাঁ, অনেক দায়িত্ব তাঁর। আইন নিজের হাতে তুলে নেন। দেন বাঁশিতে একটা ফু। জোরে। ফুউউউউউ।

ব্যস। জটলা নিমেষে হাওয়া। কী তামশা! হি হি হি।

ইশ, খেলার শেষটা আর দেখা হলো না।
কী হলো? শেষ হলো তো?

- সিকোয়েন্স তিন -
নেপথ্য কণ্ঠ 1 : আজকের যে ঘটনা টাটকা, আগামীকাল তা মিথ (myth)। পরশুদিন মিম (meme)। খবরের কাগজওলারা জানেন সেটা। সেভাবেই 'খবর তৈরি' করেন তাঁরা। আজকে করছেন সচেতনভাবে। পরদিন করেন অবচেতনভাবে।

নেপথ্য কণ্ঠ 2: উমমম... 'যা কিছু ভালো, তার সাথেই' তো থাকবে কাগজওলারা, নাকি? একটু কুশলী তো তখন হতেই হয়। তিরিশটা ভালোর ফাঁকে আধটা 'নির্দোষ কালো' মিশালেই ভালোর 'মানহানি' হয়ে গেল? উমমম... তোমরা বাপু বড্ড সেকেলে। সত্যযুগে বসে নেটচর্চা-পরচর্চা করো। তোমাদের সাথে খেলায় পারি না গো।

সম্মিলিত নেপথ্য কণ্ঠ: পারি না গো। পারি না গো। হি হি হি।

নেপথ্য কণ্ঠ 1 : তাই প্রতিদিন খবরের কাগজ আসে দরজার তল দিয়ে। দরজার তল থেকে হাতে। হাত থেকে মগজে। মগজ থেকে মগজে। তারপর আবার কাগজে। খবর আর অ-খবর পরিবহন প্রক্রিয়া চলতে থাকে।

সম্মিলিত নেপথ্য কণ্ঠ: গুরু, অনেক স্টান্টবাজি করলেন। কথা না বাড়িয়ে আজকের খবরটা শোনান। আপডেটেড থাকতে চাই আমরা। আপডেটেড।

আজকের খবর। গতকাল রাতে 'এনকাউন্টারে' এক রিকশাআরোহী ট্যাগিত। কর্তব্যরত কর্তৃপক্ষ ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। পুলিশসূত্রে জানা গেছে, ...

খবর পড়ে, মর্নিংওয়াক শেষে, অতিউৎসাহী জনাকয় প্রবীণ সে রাস্তা দেখতে যান। রাস্তায় কিছু ছেড়া ট্যাগ পড়ে আছে। সেগুলো কুড়িয়ে নেন একজন। পড়ে শোনান, জোরে জোরে। আমরা শুনতে পাই কথাগুলো :

আধা-হেগেলিয়-যুগে-প্রাপ্ত-রেফারেন্সওলা লাইনছাড়া বামকর্মী।
অসৎ-ভণ্ড-মার্ক্সীয়-কথাজীবীর ভাবশিষ্য।
বুদ্ধিবৃত্তিক-গণিকালয়ে গমনকারী।
ফমজারিয় বিভ্রান্তিতে পড়া কিছু আবর্জনার পাঠক।
ফমজারের ডট ডট ডট (বাকিটুকু পড়া যায় না, ছেড়া)।
ইসলাআআ সমাজতঅঅঅ চ্যাঅ্যাঅ্যা (লেখা বোঝা যায় না, অস্পষ্ট)।

তারা পার্কের ধারে বেঞ্চিগুলোয় বসেন। একটু জিরিয়ে নেয়া দরকার। সাথে আড্ডা চলে। থিয়েটার অব অ্যাবসার্ডের ক্যাসেট চালু হয়।

ভাবীকে সালাম দিবেন। অনেকদিন উনার হাতের রান্না খাওয়া হয় না। মেয়েটার ভালো প্রস্তাব এসেছে, ছেলে ফ্লোরিডায় থাকে, এমপির ভাতিজা। পল্টুটার বোধহয় মাথা গেছে। সারারাত কম্পুটারে কী সব টাইপ করে। নিজে নিজেই হাসে খালি। সকালে ওঠে দেরি করে। আপনার ভাবী কিছু বললেই রেগে যায়। বলে, ডিসটার্ব করো না। ব্লগ করি। অ্যাজাক্স প্রোগ্রামিং করি। এই সেই। আজকালকাল ছেলেমেয়েদের মুখের কথাই তো বুঝি না। আরে নাহ, এখনও তারিখ পাকা হয় নাই। ওহ্হো, তিন তারিখের ফ্লাইটে আসছে ছোট মেয়েটা, জামাইকে নিয়ে। তা সামনে কাকে ভোট দিবেন? বাসায় আসবেন কিন্তু। আরে গতবার যে এমপি ছিল আমাদের এলাকায়, তার ভাতিজা। ছেলে এখন আমেরিকায়, প্রস্তাবটা ভালোই। অনেকদিন ভাবীর হাতে রান্না খাই না। উনাকে সালাম দিবেন।

ট্যাগে লেখা শব্দগুলোও উঠে আসে আড্ডায়। সারা জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে শব্দগুলো পুনর্মূল্যায়ন করেন তারা।

বেলা বাড়ে। হাঁপিয়ে উঠেন এক সময়। যে যার বাসার দিকে রওনা হন সবাই।

একজন বাদে।

- সিকোয়েন্স চার -

ডাইনিং রুম। দুপুর বেলা। শব্দ নেই।
খাবার টেবিলে প্লেট সাজানো। মুড়ি রাখা তাতে।
টেবিলের একপাশে খবরের কাগজের স্তুপ।
প্লেটের পাশে রাখা সেই ছেড়া ট্যাগগুলো।
একটু দূরে আঠার কৌটা। মুখ খোলা।



[- পরবর্তী কিস্তি : ভাবনার স্প্রে ০০২ - ]

No comments:

Post a Comment