Monday, March 27, 2006

চিন্তা নিয়ে চিন্তা

মাসখানেক আগের কথা। জ-এর সাথে দেখা, শাহবাগে। তার সাথে শেষ কাজ করেছি 2004-এ, চলচ্চিত্র উৎসবে। তারপর যোগাযোগ বলতে গুটিকয়েক ই-মেইল চালাচালি, ব্যস। কী করছেন এখন, জিগ্যেস করি। 'চিন্তায় আছি,' সংক্ষেপে জবাব। বাহ, চিন্তায় কে না থাকেন! কী নিয়ে চিন্তা? ঝেড়ে কাশতে বলি। নিয়ে গেলেন আজিজ সুপার মাকের্টের ভেতরের এক দোকানে। পত্রিকা কেনালেন। 'চিন্তা' পত্রিকা। ফরহাদ মজহারের সম্পাদনায় 'চিন্তা'। এবার 'চিন্তায় থাকা'র ব্যাপার খানিকটা বোঝা গেল। এ পত্রিকা না মাঝখানে অনেকদিন বন্ধ ছিল? জানালেন, নতুন করে আবার শুরু হয়েছে, এবার নিয়মিত বের হবে।

সঙ্গে ছিল বন্ধু ব্র। আমাদের আলাপে মন নেই তার। দোকানে বই ঘাঁটাঘাঁটি করছে। ব্র-এর মাথায় ইদানীং জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার ভুত ঢুকেছে। প্ল্যান : এ নিয়ে যত বই আছে, সব কিনে ফেলবে। কিন্তু কোনটা কিনে যে শুরু করা যায়, সে নিয়েই চিন্তা।

'চিন্তা' আমার হাতেই। ফ্ল্যাপে লেখা : চিন্তা ও তৎপরতার পাক্ষিক। পাতা উল্টাই। এবারের বিষয় 'সন্ত্রাস'। সম্পাদকীয় নেই, সূচি নেই, পত্রিকার দাম কত তাও নেই। প্রথমেই লেখা দিয়ে শুরু। সম্পাদকীয় পাওয়া গেল একদম শেষের পৃষ্ঠাগুলোতে, ক্রেডিট লাইন আর দামটাও। অভিনবত্ব আনতে গিয়ে পাঠকদের বিপদে ফেলার কী মানে? নাকি বাংলা ভাষায় আরবি পত্রিকার স্বাদ?

'এবার কয় মাস পর পর বের করবেন পাক্ষিকটি?'
পুরনো রসিকতা আমার।
হাসেন।
'না না, পরের সংখ্যা প্রেসে। সত্যি... পত্রিকা পড়ে ফিডব্যাক জানাবা অবশ্যই।'

পত্রিকা পড়েছি। ফিডব্যাক জানানো হয়নি এখনও। এর জন্য নিজের অলসতাকে দায়ী করে সুখ পেয়েছি।

দীর্ঘদিন ফরহাদ মজহারের লেখা পড়িনি। বলতে দ্বিধা নেই, তার লেখা ভালো লাগে আমার। অনেকের চেয়ে স্বচ্ছ লিখেন তিনি। বিশেষ করে মার্কস-অ্যাঙ্গেলস এর তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার বেলায়। কবি হিসেবে অনেকের কাছে আদৃত, যদিও তাঁর কবিতার সাথে সেরকম পরিচয় নেই। ভালো-লাগা শুরু হয় তাঁর এক নিবন্ধ পড়ে। গণিত আর যুক্তি বিষয়ক লেখা। 'মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা'র গণিত ভলিউমে ছাপা হয় সেটা। সম্ভবত প্রতীকী যুক্তিবিদ্যার প্রথম পাঠ সেখান থেকে, সজ্ঞানে-স্বেচ্ছায়। (হাতের কাছে এ মুহূর্তে গণিত ভলিউম দুটো নেই। একটা সাক্ষাৎকারও দিয়েছিলেন বোধহয়। কবি, কবিতা আর গণিত নিয়ে। ভিন্নধর্মী ছিল। সরসও।)

দ্বিতীয়বার ভালো লাগে আরেকটি নিবন্ধ পড়ে, লালন ফকিরকে নিয়ে তার মূল্যায়ন জেনে। প্রথম আলো পত্রিকায় ছাপা হয়, সম্ভবত 2000 সালে। লালন আখড়া নিয়ে খুব হইচই হচ্ছিল তখন।

পাশাপাশি ফরহাদ মজহারকে ভয়ও হয়। এই যে তাঁর এনজিও উবিনীগ, তাঁর নয়াকৃষি আন্দোলন-- এসবের ফান্ড নিয়ে নানা কথা কানে আসে। পরিবেশ রক্ষায় হাইব্রিড-জিএম বীজের বিপক্ষে এত যে প্রচারণা, তাতে যুক্তি আছে। কিন্তু এ প্রচারণার সাথে ইউরোপিয় ইকনোমিক কমিউনিটির (ইইসি) কোনো দহরম-মহরম আছে কিনা, থাকলে কার উদ্দেশ্য কেমন-- এরকম আরো অনেক প্রশ্ন আর উত্তর মিলিয়ে নিতে ইচ্ছে করে।

কাউকে ভালো লাগালে তাকে স্বচ্ছতার দাঁড়িপাল্লায় মেপে নিতে দোষ কী? ভক্তিটা, শ্রদ্ধাটা বরং মজবুত হয়।

ফিরে আসি 'চিন্তা' পত্রিকার 'সন্ত্রাস' সংখ্যায়। নাদের ভোসেগিয়ানের অনুবাদ-লেখা দিয়ে আরম্ভ । লেখার শিরোনাম 'দেরিদা, হেবারমাস এবং সন্ত্রাসকালে দর্শন: জিওভান্না বোরাদরির সঙ্গে আলাপ'। পরের লেখাটি ফরহাদ মজহারের। 'সন্ত্রাস, আইন ও ইনসাফ' শিরোনামে। তারপর আবার অনুবাদ-লেখা। ওয়াল্টার বেনজামিনের 'বলপ্রয়োগ বিচার'। সন্ত্রাসবাদ নিয়ে একবাল আহমেদের ভাষণ আর তালাল আহমেদের সাথে আলাপ আছে। সলিমুল্লাহ খান লিখেছেন এডওয়ার্ড সায়ীদ, ইসলাম ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ে। ফরিদা আখতার লিখেছেন 'বিশ্ববাণিজ্য চুক্তির সন্ত্রাস : হংকং সভা' শিরোনামে। নয়াকৃষি আন্দোলন ও চতুর্থ সার্ক পিপলস ফোরাম নিয়েও কয়েকটি লেখা আছে। শেষ ছয় পৃষ্ঠা জুড়ে সম্পাদকীয়। এত দিন পর চিন্তা বের করার কৈফিয়ত দেয়া। সাথে পত্রিকাটি কী জানাতে চায়, তার বয়ান। পরবর্তী সংখ্যার বিষয় 'সাম্রাজ্যবাদ : যুদ্ধ ও বাণিজ্য'। এর মধ্যেই বের হবার কথা।

সমান্তরাল কিছু ভাবনার কথা বলি। বিষয় যখন সন্ত্রাসবাদ, প্রসঙ্গ যখন জাঁক দেরিদা-একবাল আহমেদ-মিশেল ফুকো, লেখাগুলো স্বভাবতই কঠিন ঠেকতে পারে। ঠেকেছেও। নিজের কাছেই প্রশ্ন করতে থাকি। কতজন হবেন এ (ধরনের) পত্রিকার পাঠক? ডিসকোর্স, ডিকনস্ট্রাকশন, পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম, নিওকলোনিয়ালিজম- এমন নানারকম শব্দ পড়ছি, শুনছি, পরিচিত হচ্ছি। আমাদের কত জনের জাঁক দেরিদা পর্যন্ত যাবার সুযোগ হয়? সলিমুল্লাহ খানে গিয়েই ভক্তি (বা অভক্তি) আটকে যাচ্ছে না তো? যিনি 'ভাষার বিনির্মাণ' পড়াচ্ছেন, তিনি নিজেই ভাষা বিনির্মাণ করে চলছেন না তো?

বিষয়ের গভীরে গিয়ে চিন্তা করতে পারছি তো? নাকি 'চিন্তা করছি' বলাটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে?

চিন্তার ব্যাপার অবশ্যই। তৎপরতারও।

[নোট : এ লেখা প্রথম ছাপা হয় সামহোয়্যারইনব্লগে।]

1 comment:

Ishtiaque Zico said...

সামহোয়্যারইন ব্লগে ছাপানোর পর পাওয়া মন্তব্য :
-------------------------------
অমি রহমান পিয়াল বলেছেন :
২০০৬-০৩-২৭ ১১:০৩:৪৬

সংখ্যাটা পড়ার পর আমার উপলব্ধিও কাছাকাছি ধরনের...

শোহেইল মতাহির চৌধুরী বলেছেন :
২০০৬-০৩-২৭ ১৮:০৩:১৭

জিকো, সবাইকে জাঁক দেরিদা, মিশেল ফুকো পড়তে হবে এমন কোনো কথা নেই। তবে যারা সমাজ দর্শন পড়তে চান, সমাজের বিবর্তন নিয়ে ভাবেন বা এর কোনো বিষয় নিয়ে কাজ করতে চান তাদেরকে তো সামাজিক বিজ্ঞানের নবতর চিন্তাগুলো জানতে হবে। এগুলো সামাজিক বিজ্ঞানের অন্তর্গত পাঠ্য বিষয়। সমাজকে বুঝতে হলে এসব বিষয় পড়তে হবে। তবে আপনাকে বলে রাখি যাদের নাম আপনি উল্লেখ করলেন তারাও লিখেছেন কমপক্ষে ত্রিশ বছর আগে। সুতরাং নতুন চিন্তা-ধারণার সাথে পরিচিত হতে হবে। আর ফুকো'র বা গ্রামসি'র বই আমিতো আজিজ মার্কেটের একুশে থেকেই কিনেছি। সুতরাং দুর্লভ নয়, হয়তো দাম বেশি। অনুরোধ করবো, মূল বই পড়বেন। অন্যের অনুবাদে খানিকটা অংশ বিশেষ পড়লে সত্যিকার ধারণাটা পাওয়া যায় না। আর মূল বইগুলোতে এতো বিস্তারিত বলা আছে যে পড়লে আপনার স্পষ্ট ধারণা তৈরি হবে। কোনো অস্পষ্টতা থাকবে না।

সলিমুল্লাহ খান ও ফরহাদ মজহারের লেখালেখির অন্যতম সমস্যা হলো তারা বিভিন্ন কৌশলে নিজেদের পান্ডিত্য প্রকাশের জন্য লিখেন। প্রায়ই আশ্রয় নেন স্টান্টের। আমার একটি পরামর্শ নেন। দুটো মূল বই পড়েন, তখন দেখবেন আপনার আশে পাশের অনেক পন্ডিতদের বিশ্লেষণী ক্ষমতা নিয়ে আপনার মনে প্রশ্ন দেখা দেবে। অনুরোধ, দুয়েকটা মূল বই পড়েন। অন্যের মুখে ঝাল খাবেন না।

মহুয়া মঞ্জুরী বলেছেন :
২০০৬-০৩-২৭ ১৯:০৩:৪৪

আরে শোমচৌ আপনি কি জানেন যে, এই সলিমুললাহ আর ফরহাদ মাজহার একে অপরের পিঠ চুলকে প্রথম আলো পত্রিকাতেই ফরহাদ মজহারকে উললাহ সাহেব 'সন্ত মজহার' বলে অভিহিত করেন। কি কারণে তিনি সন্ত সেই খবর উহ্য থাক, পরে কখনও লিখবো।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, চিন্তা পত্রিকায় যে তিনজনের নাম পেলেন এরা সবাই আত্মীয়, ফরহাম মজহারের স্ত্রী হচ্ছেন ফরিদা আখতার, আর সলিমুললাহ শিষ্য, অতএব একে পারিবারিক চিন্তা বলতে পারেন।

বকেয়া বাম অধুনা সুফি দরবেশ ফরহাদ মজহার সম্পর্কে অনেক তথ্যই জানা, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও আছে কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তিনি নিজে সুফি হয়ে বাঙালি হিন্দুকে যে এতো বিদ্বেষের ভাষায় গালি দেন যে ত্রিশের দশকের জার্মানীতে নাৎসী বাহিনীর গেস্টাপো কিংবা ইহুদিদের গণহারে গুপ্ত হত্যার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সম্প্রতি তিনি একই সঙ্গে যুগান্তর ও সমকাল পত্রিকায় এক নিবন্ধে লিখেছেন, বাংলাদেশের এক নমশূদ্র (সমরেশ বৈদ্য, চট্টগ্রামের সাংবাদিক) আরেক শূদ্রের (ভারতের সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল শংকর রায় চৌধুরী) সাক্ষাতকার নিয়েছেন... ইত্যাদি আরও নোংরামি।

সেই ফরহাদ মজহারের চিন্তা যখন আমরা জানি তখন তিনি নতুন কি আর চিন্তা দেবেন পাঠককে? থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোর....ইসলামী সমাজতন্ত্র, নয়া মোললাবাদ আর হিন্দুবিনাশ পায়েন্দবাদ ছাড়া নতুন কিছুহতেই পারে না.....শুধু শুধু মিছেমিছি লালনকে এর মধ্যে টেনে তার জাত মারা!!!
-------------------------------

Post a Comment