ভাবনার স্প্রে ০০২
২. আলোচ্য গিমিনাট্যে লেখক বোঝাতে চেয়েছেন...
স্কুলকলেজে পরীক্ষা দেয়ার সময় মুখোমুখি হতাম : 'আলোচ্য অংশে লেখক কী বোঝাতে চান?'
পাঠ্যপুস্তক থেকে নেয়া 'আলোচ্য অংশ'-এর সেই লেখক কেন জানি সে সময় বেঁচে থাকেন না। তাই পপি-পাঞ্জেরী-আকিজ ঘরানার নোটবইয়ের লেখক দায়িত্ব নেন 'আলোচ্য অংশ' বোঝানোর। এ বোঝা বিশাল বোঝা। দীর্ঘদিন সে বোঝা পিঠে বইবার ফলে ব্যথাটা এখনও পুরোপুরি যায়নি।
টেক্সট-এর অর্থবিচারে কোন পদ্ধতি বেছে নেন আপনি? লেখক কী বলছেন নাকি পাঠক কীভাবে নেবেন? সমালোচনা-পদ্ধতির বহুদিনের বিতর্ক এটা। সিমিওটিকস শাখার সাহায্য নেন কেউ। উপমা বা রূপক নয়। প্রতীক হিসেবে নিয়ে তার অর্থ বিচার করলে নাকি টেক্সটে বহুমাত্রিক অর্থ পাওয়া যায়।
সিমিওটিকস নিয়ে যতটুকু জেনেছি, গিমিনাট্যে তার নিরীক্ষা চালিয়েছি। গিমিনাট্য ডিকোড করলে কেমন হয়, একটা নমুনা দেয়া যাক।
- সামহ্যোয়ারইন রোড = চিন্তার ভাষা
- রিকশা, ট্যাক্সি, মোটরসাইকেল = ধারণা [ব্যাপক অর্থে, মিম (meme)। ধারকত্বের ভিন্নতা বোঝাতে তিন শ্রেণীর যান।]
- রিকশা = মাঝারি ধারকত্বের ধারণা। সরলীকরণ : যেসব ধারণা টিকে যাওয়ার শক্তি মাঝারি মানের।
- রিকশাচালক = ধারণার পরিবাহক।
- রাস্তার ধারে দাড়িয়ে থাকা লোক = প্রথম স্তরের পর্যবেক্ষক দল। নতুন ধারণা নিজেদের মধ্যে নেয়ার আগে যুক্তি দিয়ে যাচাই করে নিতে চান।
- বাঁ পাশের ফুটপাত = বামধারার মতাদর্শ।
- চোখে সানগ্লাস = যাচাই করার নৈতিক মানদণ্ড।
- ট্যাগ লাগানো = ধারণাকে সংজ্ঞায়িত করা, শ্রেণীভুক্ত করা
- ট্যাগট্যাগ খেলা দেখার দর্শক = দ্বিতীয় স্তরের পর্যবেক্ষক। পুরনো ধারণায় আক্রান্ত থাকেন। আবার নতুন ধারণা আসলে তাতেও প্রায়সময় আক্রান্ত হয়ে যান। যুক্তি আর আবেগের সমন্বয় করতে পারেন না।
- রাস্তার মাঝপথে কিছু লোক শিষ দেয় = পরিবর্তনের সঙ্কটকালে মধ্যপন্থী বিশ্লেষণ করা।
- লোকদের ফিসফাস আলাপ = প্রচলিত ও নতুন ধারণাগুলোর সংশ্লেষণ (সিনথেসিস) করার চেষ্টা চলে। সংশ্লেষণের বেলায় কেউ বুদ্ধির চেয়ে অভিজ্ঞতাকে বেশি গুরুত্ব দেন। কেউ 'সত্যই সুন্দর' বা 'বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর' জাতীয় মহান বাণীগুলো একরকম ঐশ্বরিক জ্ঞান করেন। আলাদা ভাবে না নিয়ে পর্যায়ক্রমে পড়লে আলাপ থেকে নতুন ধারণা বেরিয়ে আসে। পর্যায়ক্রম খেয়াল করুন। 3, 14, 15, 9,2, 6। গণিতের পাই (Pi, irrational number)-এর মান সাথে তুলনীয়। পাই এর মান 3.1415926...।
- ট্রাফিক পুলিশ = ধারণা-প্রতিধারণার যুদ্ধে চরম সঙ্কট দেখা দিলে এরা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। নিয়ন্ত্রণের সময় উপরের স্তরের নিয়ন্ত্রকের অনুবর্তী থাকেন। তবে নতুন সিদ্ধান্ত টানতে পারেন না। 'ধারণার স্বপক্ষে প্রচুর উদাহরণ' দিলে এদেরকেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ঘুষের মতো!
- নেপথ্য কণ্ঠগুলো = যাত্রাপালার 'বিবেক' বা সক্রেটিস-যুগের সফিস্টদের বর্তমান সংস্করণ। তবে এ বিবেক একইসাথে মনে করিয়ে দিতে চায়, আপনি একটা গিমিনাট্য পড়ছেন। থিসিস পেপারও না, শিল্পকর্মও না। গিমিকও না, চিত্রনাট্যও না। স্রেফ গিমিনাট্য। এক ধরনের মেটা-স্টান্টবাজি।
- প্রবীণদের আড্ডায় ট্যাগের শব্দগুলোও উঠে আসে = বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে মুক্ত হবার উপায় হিসেবে যারা সমাজ উন্নয়নের কথা ভাবেন।
জ্ঞানরাজ্যে শৃঙ্খলা আনতে প্রাপ্ত উপাত্ত যাচাই করতে হয়, তথ্যকে সাজিয়ে রাখতে হয়। এই ইনফরমেশন ডিজাইনের বেলায় ট্যাগ লাগানো গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কিন্তু জ্ঞানরাজ্যে ট্যাগ লাগানোই যদি চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হয়, সেটা শুধু খেলা হয়ে দাড়ায়। আমাদের চিন্তাভাবনার বিশাল সময় এই ট্যাগট্যাগ খেলার পেছনে চলে যায়। জ্ঞানরাজ্যের বাকি কাজ যায় বন্ধ হয়ে।
ট্যাগট্যাগ খেলার সমস্যা কোথায়? দ্রুততায়। ভাষা দিয়ে যোগাযোগের অস্বচ্ছতায়। যেমন : আপনি বলা শুরু করলেন, রবিঠাকুরের গান ভালো লাগে। ট্যাগট্যাগ খেলোয়াড় হিসেবে খপ করে কথাটি কেড়ে নিলাম। 'ও! আমি চিনি গো চিনি তোমারে। তুমি হলে রবীন্দ্র মৌলবাদী। তুমি বদ্ধচিন্তক।' প্রশ্ন করতে যাবেন। বুদ্ধিবৃত্তিক-ধর্ষণ করবো কিছুক্ষণ। বললাম, 'রবীন্দ্রনাথ নানা কায়দায় ব্রাহ্মসমাজের গুণগাণ গেয়েছেন। সুতরাং তাঁর গানের কথায় মুক্তচিন্তার ছাপ নেই। পুরুষতান্ত্রিক ছিলেন তিনি। নারীদের মানুষ ভাবেননি। শুধু নারী ভাবতেন।...'। এলোপাথারি নির্যাতন চলতে থাকবে যতক্ষণ না আপনার মনোজগতে রক্তক্ষরণ হয়। তারপর ছেড়ে দিলাম। আহ!
ধরতে পারছেন আমার যুক্তির ফাঁদ আর ফাঁক ? কূটাভাষ আর স্ববিরোধিতা? রবীন্দ্রনাথকে 'পুরুষতান্ত্রিক' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলাম। এবং আপনাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে, আপনার মনোজগতে ধর্ষণ করলাম। ধর্ষণ করে নিজেকেও 'পুরুষতান্ত্রিক' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলাম।
অনেকেই যুক্তির ফাঁক ও ফাঁদটা ধরতে পারেন না!
আর এভাবে আমি, আমরা টিকে যাই।
[ - পরবর্তী কিস্তি : ভাবনার স্প্রে ০০৩ - ]
1 comment:
______________________________
অপ বাক বলেছেন :
২০০৬-০৪-০২ ০৮:০৪:৩৮
যুক্তির ফাঁদ কি বলা যায় এটাকে? বিবেচনা এবং অবস্থানের দ্বন্দ্ব, এবং সাথে অহংকার, হারবো না মানসিকতা, অপযুক্তির ব্যঞ্জন রান্না হয় মগজে।
যুক্তি কখনই একটা স্থির সিদ্ধান্ত দেয় না, কয়েকটা সম্ভাবনা দেয়, এর পর রুচি অনুযায়ী বেছে নেওয়া,
তবে উপস্থাপনার ভঙ্গিটাই আসল, এটাকেই গিমিক বলা যায়। কতগুলো আপাত সংলগ্ন বাক্য এবং পরস্পর বিরোধী, এবং কিছু দুর্বোধ্যতা গেঁথে দেওয়া, আমরা একজন ধর্মপ্রণেতাকে পেয়ে যাবো, সেই একই রেখায় আরও একটা সরল বাক্যে আমরা পাবো আমাদের মতে মডারেট ভাবনার ধারককে, বিষয়টা শেষ পর্যন্ত দৃষ্টির ভাঁজ বা দার্শনিক সমস্যা।
সমস্যা যুক্তির না। সমস্যা অবশেষে যে যুক্তিটা দিচ্ছে সে কী প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে সেটার উপরে নির্ভর করে। মনোজগতে আদর্শিক ধর্ষণ না নিজের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, যাই হোক এর আগের লেখাটা গেছে অন্য এক ট্যাগে। ওটার ট্যাগ ঠিক করতে হবে।
______________________________
Post a Comment