দিনলিপি : আলো বলতে তখন স্ট্রিট ল্যাম্প
লেখাটা চোখে পড়লো আজ। সামহোয়্যারইন ব্লগে শ্যাজা আপা লিখেছেন আমাদের সাক্ষাৎ নিয়ে। শ্যাজা আপা নাকি সুমেরু'দার স্ত্রী? কোন পরিচয় আগে? না, এখানে কোনো অর্ডার নেই, ক্রম মানতে বলবেন না আমাকে, পুড়ে যাক এসব ধারাবাহিকতা কাঁথা।
তবে তার আগে সুমেরু মুখোপাধ্যায় ঢুকে যাবেন এ অনুচ্ছেদে। সুমেরু'দার সাথে পরিচয় ব্লগসূত্রে। তার লেখা পড়ি নীরবে। নিরীক্ষা থাকে লেখায়; উত্তরাধুনিকতা, পরাবাস্তবতার ছোঁয়া পাই, ভালো লাগে। তাঁর এপ্রিলের প্রথম দিনের স্বপ্ন না বলে দেখেছি অনেকদিন।
লেখার পাশাপাশি সুমেরু'দাকে ভালো লাগার আরেকটা কারণ, সিনেমা ভালোবাসেন তিনি, দেখতে এবং বানাতে। একদিন দেখি, তার পছন্দের তালিকায় ঢুকে গেছে আমার ব্লগ। বাহ, এ অহংকারী চুনোপুটির লেখাও পড়েন তিনি? মজার তো, দু জনই দু জনের লেখা পছন্দ করি, কিন্তু আলাপ হয়নি কারও।
আলাপ হয়েছে, পরে, অরকুটে। চলচ্চিত্র দাস নামে লুকিয়ে ছিলেন। একবার লিখতে বললেন গুরুচণ্ডালি'র জন্য। গড়িমসি করে আর দিইনি লেখা। ফরমায়েশি কাজে আমার বরাবর কুড়েমি, অনীহা।আমাদের স্ক্র্যাপ হয়েছে অল্প, ইমেইল হয়েছে তারও কম। গুগলে সার্চ মেরে মনে মনে তাঁর পোর্টফোলিও দাঁড় করাই। ফটো অ্যালবাম দেখে অনুমান করে নিই, পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ছিলেন। আর লিখেন অনেক, পেলে পড়ি, কম্পাঙ্ক মিলে যায় কোথায় যেন...
মাঝে মাস কয়েক-- হিসেব করিনি সংখ্যা দিয়ে-- আর যোগাযোগ হয়নি। কখন যে হাওড়া থেকে বুদাপেস্ট উড়াল দিয়েছেন, টের পাইনি। গত সোমবার মেইল পেলাম, কোরিয়া আর ইরানের কিছু সিনেমা খুঁজছেন, পরিচালক ধরে লিস্ট পাঠালেন। আর দরকার সারি গান। ময়মনসিংহ গীতিকাও। জানালেন, তাঁর স্ত্রী শ্যাজা ঢাকায় আর একদিন আছেন, ফোন নম্বর দিলেন, যেন যোগাযোগ করি। মাঝে সময় একদিন। পরদিন দুপুরে ফোন করি শ্যাজা আপাকে। কী বলে ডাকবো? বৌদি ডাকলাম প্রথম। ডাকাডাকি ভালো লাগে না, ভাববাচ্যে আলাপ চালাই, হ্যাঁ হ্যাঁ এটা আমি ভালো পারি, নিরাপদ দূরত্বের জাল বুনতে। বললেন, রাইফেলস স্কয়ার আর বসুন্ধরা সিটিতে খুঁজেছেন। পেয়েছেন গুটিকয়েক সিনেমা। আমার কাছে তখন শাহবাগ। আজিজের নিচে দুয়েকটা ডিভিডির দোকান হয়েছে, অনেক কালেকশান, গেলাম সেখানে। লিস্ট ধরে খুঁজলাম, ইরানের ফিল্মগুলো নেই, কোরিয়া শুনে চোখ পিটপিট। জঞ্জাল, জঞ্জাল মনে হলো দোকানের বাকি সব ডিভিডি!
ফিরে এলাম বাসায়। ক্লান্ত ছিলাম, ঠিকমতো ঘুম হয়নি আগের রাত। উঠলাম সন্ধ্যায়, সাড়ে সাতটা তখন, রাইফেলস স্কয়ার বন্ধ। জোগাড় বলতে শুধু ময়মনসিংহ গীতিকার বই। শ্যাজা আপাকে জানাই সে কথা। বই না, সুমেরু'দা নাকি খুঁজছেন অডিও, আমারই বুঝতে ভুল হয়েছে। ময়মনসিংহ গীতিকার অডিও? হ্যাঁ, দেওয়ানা-মদিনার কয়েকটা গান ছিল তো আমার কাছে। কোনো সিডিতে রাইট করা। যেহেতু তখন ভীষণভাবে খুঁজছি, তাই কোথাও খুঁজে পেলাম না। মারফি'র সূত্র!
মন চুপসে গেল, হ্যাঁ হ্যাঁ মেঘপিয়ন, কোনো সাহায্যই করতে পারছি না এ বেলায়। সুমেরু'দার সাথে আলাপ করে একটু পর শ্যাজা আপা জানালেন, বইতেই চলবে।এটা নিশ্চয়ই ভদ্রতা। 'না' বলতে পারছেন না তিনি, পাছে মন খারাপ করি। ঠিকানা দিলেন। গেলাম। রাত নয়টা পেরিয়ে, লোডশেডিং চলছে তখন, ট্যাক্সিক্যাবও।
দাঁড়িয়েই কথা হলো, আধঘণ্টা বোধহয়, সময় দেখিনি, কত প্রসঙ্গ-অপ্রসঙ্গ এলো, ব্লগ নিয়ে, লেখা নিয়ে, সিনেমা নিয়ে, সুমেরু'দা নিয়ে। রেইনবোর আগের কোন ফিল্ম ফেস্টিভালে নাকি লোগো ফিল্ম তৈরি করেছেন সুমেরু'দা।এখন ইটিভি বাংলায় সকালের একটা লাইভ প্রোগ্রাম করছেন, ফরমায়েশি কাজ, বলেন না কাউকে, নিছক জীবিকার তাগিদে আপোশ। হ্যাঁ হ্যাঁ, সম্ভবত আপোশ অনুভূতিটার সাথে আমি পরিচিত।
বাংলালাইভ সাইটে শারদীয় সংখ্যায় একটা গল্প বেরিয়েছে শ্যাজা আপার। এক ঝলক দেখেছিলাম আগে, পড়া হয়নি, মনে পড়ছে, মাঝে সুরার আয়াত ছিল। অপ্রসঙ্গ। কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভালে সাত দিনে আঠারো সিনেমা দেখেছেন। আমি একবার দেখেছি সর্বোচ্চ একুশটা। সাত দিনে। অপ্রসঙ্গ। স্প্রিং সামার ফল উইন্টার অ্যান্ড সামার, লোডশেডিং তখনও।
শ্যাজা, কিংবা সা, বা সা হু, বাংলাদেশের মেয়ে। জন্ম সিলেটে, পড়াশোনা চট্টগ্রামে, গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া নাকি কুমিল্লা, মনে পড়ছে না ঠিক। ঊনিশ শো সাতাশিতে, হ্যাঁ হ্যাঁ আমি ইস্কুলে তখন সবে, চলে যান পশ্চিমবঙ্গে। কেন গেলেন, কীভাবে গেলেন, জানতে ইচ্ছে করছিল না, এই যে পাশের দোকানে মোমবাতি জ্বালিয়ে বিশ্বকাপের আলাপ করছে দোকানীরা, এই যে আমরা কথা বলছি ফ্লাইওভারের অদূরে দাঁড়িয়ে, অপরিচিত কোনো আপনজনের সাথে, এই এখনটাই ভালো লাগছে। এই তো বেশ দাঁড়িয়ে আছি স্ট্রিট ল্যাম্পের আলো মেখে।
কিন্তু দেজা ভু শুরু হয়েছে আমার, কথা লেপ্টে যাচ্ছে, একটু পরে তোতলাবো নির্ঘাৎ। বিদায় নিতে হবে। আবার দেখা হবে, কথা হবে, যদিও গুছিয়ে কথা বলতে পারি না মোটেই। পোস্টমাস্টার গল্পের রতন মাথার ভেতর উদয়হচ্ছে, মাদার ইন ম্যানভিলের জেরি উদয় হবে একটু পর, ফিরে যাও তোমরা, যতসব বাজে গল্প, বাজে চরিত্র, বিরক্ত করো না এখন আমাকে, প্লিজ।
রিকশায় চড়লাম, আফরিনাকে জানাতে ইচ্ছে করছে ঘটনাটা, ফোন অফ তার। হ্যাঁ হ্যাঁ, এটাও দেজা ভু, ঠিক এমন ঘটনা-পরম্পরা ঘটেছে এর আগেও। এই রিকশা, লোডশেডিং, ফ্লাইওভার, রাত, ফোন অফ, রতন, জেরি-ফেরি, আগেও হয়েছে। আমার মনে পড়ছে না ঠিক, দরকার নেই মনে পড়ার, কানে জন ডেনভার, বাসায় যাবো আমি, জেটপ্লেনে চড়ে।
No comments:
Post a Comment