সাক্ষাৎকার : মসিহ্উদ্দিন শাকের
মসিহ্উদ্দিন শাকের। 1979 সালে নির্মাণ করেছেন 'সূর্যদীঘল বাড়ী', শেখ নিয়ামত আলীর সঙ্গে। বাংলাদেশের সিনেমা ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য কাজ এটি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পায় ছবিটি। সদ্যসমাপ্ত নবম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ছবি বাছাই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। ছিলেন ইনডিপেনডেন্ট সিনেমা বিভাগের বিচারকও।
উৎসব চলাকালে পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরে পেয়ে যাই তাকে। আড্ডা চলে অনেকক্ষণ। উৎসবে ছবি বাছাই, উৎসব নিয়ে তার টুকরো স্মৃতি, দেশের চলচ্চিত্র আন্দোলন -- এরকম নানা প্রসঙ্গ চলে আসে কথায় কথায়। সেখান থেকে কিছু কথা :
জিকো : এ উৎসবে ছবি বাছাইয়ের বেলায় কোন বিষয়গুলো বিবেচনা করেছেন?
ম. শাকের : বাছাইয়ের সময় প্রথম দেখেছি, কোনো ছবি যেন দেশীয় মূল্যবোধকে আহত না করে। ছবির চিত্রনাট্য, ক্যামেরাশৈলী, সম্পাদনা, তার শিল্পগুণ -- এভাবে আলাদাভাবে না দেখে সামগ্রিকভাবে দেখা হয়েছে। আর অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ায় গত দু বছরে নির্মিত সিনেমাগুলোর কয়েকটি প্রতিযোগিতা বিভাগে স্থান পেয়েছে।
জিকো : উৎসবে দেখানো ছবির মান নিয়ে কিছু বলুন।
ম. শাকের :সবগুলো আপ-টু-দ্য-মার্ক নয়। আর আমাদের উৎসবে যে অনেক ছবি জমা পড়ে, তাও না। নানা দেশ থেকে দু'শোর মতো ছবি জমা পড়ে, সেখান থেকে হয়তো দেড়শো ছবি বাছতে হয়। তারপরও বলবো, ভালো কয়েকটা ছবি এসেছে এবারের উৎসবে।
জিকো : আমাদের এখানে কেন ভালো ছবি জমা পড়ে না?
ম. শাকের : কারণ তো অনেকগুলো। ঢাকায় এই যে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হচ্ছে, কজন রাখেন এ খবর? কান, ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের মতো আমাদের তো এত বড় আকারের হয় না। সেসব ফেস্টিভ্যালে সিনেমাটি 'মনোনীত' হয়েছে -- শুধু এ দিয়েই অনেক সিনেমার বাণিজ্যিক প্রমোশন করা হয়। দ্বিতীয় সমস্যা ছবি সেন্সরিং নিয়ে। বাইরের দেশের নির্মাতারা যখন দেখবেন, উৎসবে তার ছবি বাছাইয়ের পরও সরকারি সেন্সর বোর্ডের কাচির নিচে যেতে হয়, তাহলে কেন তারা ছবি জমা দেবেন? বিদেশের আর কোনো ফেস্টিভ্যালের ছবিতে এরকম সরকারি সেন্সর হয় না। ফেস্টিভ্যালের ছবি বাছাইয়ের পর সরকারি সেন্সর বোর্ডের ভূমিকা অর্থহীন। সেন্সর বোর্ড তুলে দেয়া উচিত। আরেকটা ব্যাপার, বড় ফেস্টিভ্যালগুলোতে ছবি প্রদর্শনের জন্য নির্মাতাকে সম্মানী দেয়া হয়। আমরা তা দিতে পারি না। আমাদের বাজেট সীমিত থাকে। প্রযোজকরা তাই আগ্রহী হন না। এছাড়াও এয়ারপোর্টে ফিল্ম রিল আটকে রাখে। কাস্টমস ঝামেলা করে। সরকারি গোয়েন্দারা ফেস্টিভ্যালে নাক গলায়।
জিকো : বিদেশের ফেস্টিভ্যালের ছবি মনোনয়ন নিয়ে আপনার মন্তব্য --
ম. শাকের : বিদেশের বড় বড় ফেস্টিভ্যালে ছবি মনোনয়ন এবং পুরস্কারের স্বচ্ছতা নিয়েও আমার দ্বিধা আছে। খোদ কান ফেস্টিভ্যাল নিয়েই নানা কথা কানে এসেছে। নাম বর্লিছ না। ধরা যাক : ক, খ, গ তিন দেশের তিন বিচারক। এখন 'খ' দেশের ছবি হয়তো পুরস্কার পাবার যোগ্যতা রাখে না। কিন্তু খ দেশের প্রতিনিধির লবিংয়ে সেটা পুরস্কার পেয়ে যায়। এ ধরনের ঘটনা কান ফেস্টিভ্যালের মতো জায়গায় হয়।
জিকো : আপনার ছবি তো জার্মানিতে পুরস্কার পায়। সেখানকার অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু বলুন।
ম. শাকের : 'সূর্যদীঘল বাড়ী' জার্মানির ম্যানহেইম ফেস্টিভ্যালে তৃতীয় হয়। 1980 সালের কথা। ছবিতে মানবিক আবেদনের জন্য ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট -- দুই জুরি কমিটিই ছবিটির পক্ষে আলাদাভাবে রায় দেয়। পরে সুইজারল্যান্ডের বিচারকের কাছ থেকে শুনেছি, আন্তর্জাতিক জুরিবোর্ডের আরেক জার্মান সদস্য জোর করে পোল্যান্ডের সিনেমাকে প্রথম করেছে। সে কারণটা রাজনৈতিক। পোল্যান্ডের গদানস্কে তখন সলিডারিটি আন্দোলন চলছিল। আর পোল্যান্ডের সে ছবি ছিল অ্যান্টি-কমিউনিস্ট। সিআইএ-এর প্রভাবে জার্মান সরকার সিদ্ধান্তটা নেয়। পোল্যান্ডকে প্রথম করে জামার্নির পক্ষে আনার চেষ্টা করেছিল জার্মান সরকার।
জিকো : উৎসবের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এ নিয়ে নয় বার ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব হয়ে গেল। দর্শক কি বেড়েছে?
ম. শাকের : ফেস্টিভ্যালে চলচ্চিত্রানুরাগী দর্শকদের সমাগম বাড়ছে। এর কারণ হয়তো মূলধারার ছবির বর্তমান দৈন্যদশা। তবে সাধারণ দর্শকরা কিন্তু সে অনুপাতে আসছেন না। কেন আসছেন না, তার কারণটা আরও গভীরে। সেটা শিক্ষায়। শিক্ষার ন্যূনতম স্তর পার তো হতে হবে, তারপর সিনেমার ভাষা বোঝার ব্যাপার আসে। আবার ইংরেজি সাবটাইটেল পড়ে অর্থ উদ্ধার করতে পারেন না অনেকে।
জিকো : উৎসবের মান কি ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে?
ম. শাকের : না, তেমনটি বাড়ছে না। দু-চারজনের উদ্যোগেই প্রতিবার ফেস্টিভ্যালগুলো আয়োজন হচ্ছে। অন্যান্য সমস্যাও আছে। প্রতি ফেস্টিভ্যালে নতুন চলচ্চিত্রকর্মীরা আসেন। আগের কর্মীরা হারিয়ে যান, নিজেদের মধ্যে ভাগ হয়ে যান। এখনকার কর্মীদের মাঝে ডেডিকেশনের অভাব আছে। চলচ্চিত্রকর্মীরা যেন রাজনীতিবিদদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। রাজনীতিতে দলাদলি, ফিল্ম সোসাইটিতেও দলাদলি। দলাদলির এ রাজনীতি সংস্কৃতিতে প্রভাব ফেলছে।
জিকো : উৎসবের শ্লোগান 'বেটার ফিল্ম, বেটার অডিয়েন্স, বেটার সোসাইটি'। ভালো চলচ্চিত্র কি ভালো সমাজ গড়তে পারে?
ম. শাকের : পারে, তবে একা পারে না। সামগ্রিকভাবে দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি যদি ভালো না হয়, তবে ভালো চলচ্চিত্রই আশা করা যায় না। ভালো সমাজ গড়ার প্রশ্ন আরো পরে আসে। আমরা কখনও কখনও ভাবি, কালচার পলিটিক্সকে নিয়ন্ত্রণ করুক। সেটাও ঠিক বাস্তবসম্মত প্রত্যাশা নয়। রাজনীতির ক্ষমতা যাদের দখলে, তারাই সংস্কৃতিতে আধিপত্য করছে। রুলিং ক্লাশ কালচার ইজ দ্য ডোমিনেটিং কালচার, কাল মার্কসের কথা এটি।
জিকো : আমরা কি তবে আশাবাদী হবো না?
ম. শাকের : আশাবাদী হতে হবে। এখনকার সংস্কৃতি আন্দোলনগুলো সরকারের দখলে। সুস্থ চলচ্চিত্রকর্মী, সংস্কৃতিকর্মীদের রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হলে চলবে না। সংস্কৃতির ভালো চাইলে সংস্কৃতিকর্মীদের 'পলিটিক্যাল ফাইট' দিতে হবে।
------------------------------------
ইশতিয়াক জিকো / 22 জানুয়ারি 2006 / ঢাকা
[নোট : সাক্ষাৎকারটি প্রথম ছাপা হয় নবম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের 'প্রতিদিন উৎসব' বুলেটিনে । এবার উৎসব বুলেটিনের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলাম। শেষ অনুচ্ছেদের বোল্ড করা অংশটি প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের শিরোনাম ছিল। কিছুটা পরিমার্জিত।]
No comments:
Post a Comment