Sunday, January 29, 2006

হিডেন (Caché): মিশাইল হানেকের সিনেমা



অস্ট্রিয়ার পরিচালক মিশাইল হানেকে (Michael Haneke)। কান চলচ্চিত্র উৎসব ২০০৫-এর বেস্ট ডিরেক্টর অ্যাওয়ার্ড পান তার 'হিডেন' সিনেমার জন্য।

কী আছে সিনেমাতে?
কী ঘটে শুরুতে?
কিছুই না।

ক্যামেরা শুধু ফোকাস করা থাকে প্যারিসের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবাসিক এলাকার এক বাড়ির দিকে। আশেপাশে পথচারী যাচ্ছে, আসছে। মাঝে মাঝে গাড়ি চলছে রাস্তায়। একটা লোক বাড়ি থেকে বের হয়।

দৃশ্য বদলায় না।
স্থির থাকে ক্যামেরা।

যেন ক্যামেরার পেছনে কেউ অপেক্ষা করছে কিছু একটা ঘটার। কিছুই ঘটে না। সময় যায়, কৌতুহল বাড়ে : কেন ক্যামেরাটা বাড়িটার দিকে তাক করা? কী হচ্ছে বাড়িটাতে? কে দেখছে ক্যামেরা দিয়ে? কেন? আর কীইবা ঘটবে?

মিশাইল হানেকের এ সিনেমায় সাসপেন্স শুরু হয় একদম গোড়া থেকেই। 'কে দেখছে-কে করছে' এরকম প্রশ্ন দর্শকের আগ্রহ ধরে রাখে সারাক্ষণ। এটাই গল্প।

রাস্তার ওপার থেকে বাড়ির পর্যবেক্ষণ করার বিষয়টি দেখা যায় ভিডিও ক্যাসেটে। ক্যাসেটটি পাওয়া যায় মধ্যবিত্ত কোনো পরিবারের বাড়ির দরজায়। সে বাড়ির কর্তা, জর্জ, টেলিভিশনের জনপ্রিয় শো চালায়। জর্জের স্ত্রী অ্যানি একটা পাবলিশিং হাউসে কাজ করে। তাদের এক ছেলে পাইরট, বারো বছর বয়স তার।

প্রথমেই দেখা যায় তাদের সুখী সাচ্ছন্দ্য পরিবারের চেহারা। চাকরি, বন্ধুবান্ধব, চমৎকার অ্যাপার্টমেন্ট, বই, স্টাইলিশ আসবাবপত্র, এখনকার দিনে যা যা দরকার মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া জীবনে। খেয়াল করুন, কীভাবে চারপাশ দেখানো হয়েছে। পরে বুঝতে পারি, মিশাইল হানেকে এই চারপাশটাই আঘাত করতে চেয়েছেন।

আপাতত আমরা ভিডিও-থ্রিলারে আছি। দরজায় রাখা এই টেপটি দেখে জর্জ-অ্যানি দম্পতি বিরক্ত হয়, আমরাও হই। এর কোনো মানে দাড়ায় না তাদের কাছে, আমাদের কাছেও। তার ওপর পরিচালক হানেকে তার ক্যামেরার দৃশ্য আর সেই ক্যাসেটে ধারণ করা ভিডিও দৃশ্য টেকনিক্যালি মিশিয়ে দিয়েছেন।

কদিন পর আরো ক্যাসেট এসে হাজির হয়। এবার ক্যাসেটের ভিডিওতে অদ্ভুত সব মিল। জর্জের পরিবারের ও জর্জের জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা রেকড করা সেসব ভিডিও ক্যাসেটে। জর্জ-অ্যানির ভয় বাড়ে, নিরাপত্তহীনতায় ভোগে তারা। পুলিশের কাছে জানায় ব্যাপারটা। কিন্তু হুমকি বা ব্ল্যাকমেইলের কোনো ইঙ্গিত না থাকায় পুলিশেরও কিছু করার থাকে না। রহস্য মীমাংসা করতে হবে তাদেরই। দুজনই ধীরে ধীরে ভীত, শঙ্কিত হয়ে পড়ে। তাদের বুর্জোয়া চেহারা খসে পড়ে।

শেষ পর্যন্ত কী হয়?
রহস্যময় থ্রিলারের কোনো কিনারা পাওয়া যায় কি?

পাওয়া গেলে তা অবশ্য মিশাইল হানেকের সিনেমা হতো না। হানেকে এ সিনেমায় থ্রিলার থেকে আরো দূরে সরে যায়। সিনেমার চরিত্ররা নিজেদের যেভাবে দেখে, সেভাবেই চ্যালেঞ্জ করেন তিনি। তার ক্যামেরা ইন্দ্রিয়ের মতো ব্যবহৃত হয়, সে ইন্দ্রিয় ঢুকে যায় পশ্চিমা আধুনিক মধ্যবিত্ত সমাজের আত্মতৃপ্তির গভীরে। আমরা ধরে নিই, ভিডিও'র আড়ালে কোনো চরিত্র নেই (সিনেমার বাণিজ্যিক পরিবেশকরা মন খারাপ করতে পারেন এর জন্য)। পরিবারের বুর্জোয়া খোলস ভেদ করতে কৌশলটা চমৎকার। হানেকে এতটা পর্যবেক্ষণশীল আর মনোযোগী না হলে কৌশলটা হয়তো লুই বুনুয়েলের মজার কোনো আবিস্কার হতো।

তো হানেকে বুর্জোয়ার অস্তিত্ত্বের গভীরে গেলেন কীভাবে? শুধু সাধারণ কিছু 'ইনার মনোলগ' দিয়ে। জর্জের জানতে ইচ্ছে হয় সে কাউকে আঘাত বা কারো মনে ব্যথা দিয়েছিল কিনা যে এখন এভাবে প্রতিশোধ নিচ্ছে। তার মনে অপরাধবোধ কাজ করতে থাকে, কোনো শক্ত কারণ ছাড়াই; আরো আক্রমণাত্মক হয়। ফ্ল্যাশ ব্যাকে সে ফিরে যায় শৈশবে, 1961 সালে। আলজিরিয়ায় ফরাসি যু্দ্ধ চলার সময় ফ্রান্সে বসবাসকারী আলজিরিয়ানদের ওপর নির্যাতন চলছে। ভিডিও টেপে দেখা যায় এরকম এক আলজিরিয়ান পরিবার, ফ্রান্সে অভিবাসী, জর্জের বাবা-মা'র জন্য কাজ করতো। সেই অভিবাসীদের ছেলে, জর্জের সমবয়সী, এখন প্যারিসেই থাকে। হয়তো সেই ছেলেই ক্যাসেটগুলো পাঠিয়েছে এতদিন পর। অভিবাসীদের প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছিল, তারই হয়তো প্রতিশোধ। জর্জ ব্যাপারটাকে এভাবেই নেয়।

কিন্তু আমরা এর মধ্যেই বুঝতে পারি, মিশাইল হানেকে ব্যক্তিগত অপরাধবোধের গল্প বলেননি। এ চাপা অপরাধবোধটা আলজিরিয়ার প্রতি ফ্রান্সের, তৃতীয় বিশ্বের প্রতি প্রথম বিশ্বের, গরীবের প্রতি ধনীর, শিকারের প্রতি শিকারীর।

কেউ হয়তো এভাবে ব্যাখ্যা করবেন, হানেকে যে দেশে সিনেমাটি বানিয়েছেন, সে দেশকেই ধিক্কার জানিয়েছেন, মার্জিতভাবে। অথবা কেউ বলতে পারেন, ফরাসি উপনিবেশিকতাবাদ নিয়ে কাজ করেছেন তিনি, যে কাজের পুনর্মূল্যায়নটা জরুরি। কেউ বলবেন, তিনি সমাজের এমন এক শ্রেণী দেখিয়েছেন যে কিনা নিজের কাছেই প্রশ্ন করে :

কার টাকায় এত বর্ণাঢ্য জীবনযাপন সম্ভব?

সিনেমাটি তাই বলে।

সামগ্রিক অর্থে, পশ্চিমা দুনিয়া আর সেখানকার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভেতর সামাজিক চেতনার অভাবটাকেই দেখিয়েছেন মিশাইল হানেকে। অচেতন বা 'অবদমিত চেতন', যাই হোক না কেন, দুর্বলতাগুলোকে খারাপ লাগার কারণ আছে আমাদের সবার। মিশাইল সেটাই মেলে ধরেছেন। দয়ামায়া ছাড়াই তিনি তা করেছেন তার সিনেমায়। ধনের প্রাচুর্য্যের সাথে সামাজিক-ঐতিহাসিক চেতনার অভাব, অপরাধবোধের সাথে অবদমন-- সমসাময়িক পশ্চিমা সমাজের এসব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সংযোগ দেখিয়েছেন তিনি।

পশ্চিমা সমাজ নিজেদের যেভাবে দেখে, তার প্রতি এমন নির্ভয়, কঠোর আর নির্দয়ভাবে চ্যালেঞ্জ জানায়নি সাম্প্রতিক আর কোনো ছবি।

-- ইশতিয়াক জিকো / জানুয়ারি 2006

[ফুটনোট: ক্লাউস এডার ও পেদ্রো বুচারের সমালোচনা পড়ে প্রতিক্রিয়াটি লিখেছিলাম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব বুলেটিনের জন্য ।]

No comments:

Post a Comment